বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে। ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে তিনি মানুষের চিন্তার জগতে কয়েকটি বৈপ্লবিক ধারনার সৃষ্টি করেছিলেন। এই ধারণাগুলির মধ্যে ভর ও শক্তির বিনিময়তা ছিল অন্যতম। তার সেই বিখ্যাত সমীকরণটি হল, E=mc2। এখানে E দ্বারা শক্তি m দ্বারা ভর এবং c দ্বারা প্রতি সেকেন্ডে আলোর বেগকে বোঝান হয়েছে। অর্থাৎ পদার্থের ভরকে আলোর বেগের বর্গ দ্বারা গুণ করলে যে শক্তি পাওয়া যায় সেটাই হল ঐ পরিমাণ পদার্থের আবদ্ধ শক্তি।
আমরা জানি যে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩০ কোটি মিটার অর্থাৎ ১৮৬০০০ মাইল । সুতরাং খুব অল্প পরিমাণ পদার্থকেও যদি ৩০ কোটির বর্গ দিয়ে গুণ করা হয় তাহলে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে সেটার হিসাব বের করা খুব কঠিন নয়। তখন তার মর্ম না বুঝলে ও পরবর্তিতে তার মর্ম যথাযথ ভাবে বুঝেছে মানুষ।
দুই হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস পরমাণুর ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন। atom ইংরেজি শব্দ যার প্রতি শব্দ পরমাণু। যাকে আর ভাগ করা যায় না। ডেমোক্রিটাসের মতে, ‘পৃথিবীতে একমাত্র বিদ্যমান পদার্থ হল পরমাণু ও শুণ্যস্থান, আর বাকি সব কিছু অভিমত মাত্র।
উনবিংশ শতাব্দীতে জন ডালটন পদার্থের পারমাণবিক গঠনের ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ডালটনের মতবাদের অনেক সমালোচনা হওয়ার পর বেকারেল, পিয়ারে কুরি ও মেরি কুরি বিজ্ঞানী কতৃক তেজষ্ক্রিয় মৌলের আবিষ্কার, থমসন কতৃক ইলেকট্রনের আবিষ্কার এবং ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম ও থোরিয়াম থেকে নির্গত তেজষ্ক্রিয় রশ্নির অনুশীলন করার পর সন্দেহের কোন অবকাশ রইল না যে পদার্থের গঠন সত্যিই পারমানবিক। পরবর্তিতে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড পরমাণুর একটি মডেল আবিষ্কার করেন। যেখানে তিনি বলেছেন পরমাণুর একটি কেন্দ্র আছে যার নাম নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে থাকে ধনাত্নক আধান বিশিষ্ট প্রোটন এবং চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রন। আর নিউক্লিয়াসের বাইরে বৃত্তাকার কক্ষ পথে থাকে ঋণাত্নক আহিত ইলেকট্রন। ইলেকট্রন গুলো সর্বদা ঘূর্ণায়মান। পরমাণুর মোট ভরের শতকরা ৯৯.৯৭৫ অংশ অবস্থিত এই নিউক্লিয়াসে। এর গড় ঘনত্ব প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে প্রায় ৩x১০০০০০০০০০০০০ কিলোগ্রাম। পরমাণুর উপাদান প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রনের মোট ভরের তুলনায় পরমানুটির ভর যতটা কম তাকেই শক্তির একক কে E=mc2 প্রকাশ করলে আমরা পরমাণুর সংযোগী শক্তির সন্ধান পাই।
১৯৩৮ সালে জার্মানীর অটোহান এবং স্ট্র্যাসম্যান নামে দুইজন রসায়মবিদ ইউরিনিয়াম ২৩৫ মৌলের পরমাণু ভাঙ্গতে সফল হন। ফলে সারা বিশ্বে হৈচৈ পড়ে যায়। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৮ সালের এক অধিবেশনে বোর পরমাণুর ভাঙ্গন ও তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীদের কাছে ঘোষণা করলেন। বোরের ভাষণ শেষ হওয়ার আগেই শ্রোতাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন দ্রুত সভাকক্ষ ত্যাগ করে টেলিফোনে ব্যাপারটা স্ব স্ব গবেষণাগারে জানিয়ে দিলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই ওয়াশিঙটনের কারনেজ ইনস্টিটউশন এবং কলম্বিয়া বিম্ববিদ্যায়ের বিজ্ঞানীরা হানস্ট্র্যাসমেন আবিষ্কারকে স্বীকৃতি জানালেন। কারণ পারমাণবিক বোমা নির্মাণের চাবিকাঠি নিহিত ছিল এই আবিষ্কারটিতে। নির্ধারিত কোন কোন ভারী পরমাণুর একের পর এক পর্যায়ক্রমিক বিভাজন প্রক্রিয়াকে সমপ্রতিক্রিয়াধারা বলা হয়। সহজে বিদারণীয় মৌল দ্বারা বন্দীকৃত এই নিউট্রিন পরবর্তী পর্যায়ের বিভাজন ঘটায় এবং এ ভাবেই ধারাটা চলতে থাকে। পারমাণবিক বোমায় এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। পারমাণবিক শক্তি বা অস্ত্র উৎপাদনের জন্য দরকার এমন একটি প্রক্রিয়ার সূচনা করা যাকে বলা হয় সমপ্রতিক্রিয়াধারা। ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়াস মোটামুটি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হলে যদি সেই সাথে এক বা একাধিক নিউট্রন নির্গত হয় তাহলেই শুধু সমপ্রতিক্রিয়াধারা ঘটানো সম্ভব।
১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে জোলিয়ো কুরি ও তার সহযোগিরা দেখালেন যে ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়াস ভাঙ্গলে নিউট্রন বের হয়ে আসে। এ আবিষ্কারের মারাত্নক সম্ভাবনা ও পরিণতি সম্বন্ধে ঝিলার্ড ও ফার্মী সচেতন ছিলেন। যার ফলে ঝিলার্ড ও ফার্মী আগে থেকে ইউরিনিয়াম ভাঙ্গার রহস্য প্রকাশ করেন নি এবং জোলিয়ো ও কুরিকে তা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু জোলিয়ো ও কুরি বুঝলেন উল্টো। তারা মনে করলেন ঝিলার্ড ও ফার্মী তাদের আগে তা প্রকাশ করে করবেন।
সমসাময়িক সময়ে সমপ্রতিক্রিয়াধারা অন্বেষনে ফরাসীরা অন্যদের তুলনায় বেশ অনেকখানি এগিয়ে ছিল। তাই জোলিয়ো ও কুরি গোপনীয়তার কথা প্রত্যাখান করলেন। ১৯৩৯ সালের ১৫ এপ্রিল ফিজিক্যাল রিভউ পত্রিকায় প্রকাশিত হল ঝিলার্ড ও তার সহকর্মীদের প্রবন্ধ। এক সপ্তাহ পরে ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়াস বিভাজনে নির্গত নিট্রনের সংখ্যা। শিরোনামে ফরাসী বিজ্ঞানীদের একটি নতুন প্রবন্ধ 'দি নেচার' প্রত্রিকায় প্রকাশিত হল। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল নিউট্রনের গড় সংখ্যা ৩ থেকে ৪ এর মধ্যে। ফরাসী বিজ্ঞানীরা দ্রুত ৫টি পেটেন্ট গ্রহণ করে তাদের অগ্রগামী অবস্থার পরিচয় দিলেন। ইউরিনিয়াম ও মডারেটর কি অনুপাতে সন্নিবিষ্ট করতে হবে এবং সন্নিবেশে তাদের সমসত্ব ও অসমসত্ব বিন্যাস এ পেনেন্টে উল্লেখ ছিল।
বিভাজনে নির্গত নিউট্রন মন্দনের জন্য মডেরেটর হিসাবে বেরিলিয়াম, গ্রাফাইট, পানি এবং ভারী পানি ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সমপ্রতিক্রিয়াধারাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বেশ কয়েকটি উপায় আলোচিত হয়েছিল এবং উৎপন্ন তাপকে কিভাবে সংগ্রহ করা যায় সে সম্বন্ধে কয়েকটি পদ্ধতিও এ পেটেন্টে বর্নিত হয়েছিল। ইউরিনিয়াম ২৩৫ এর মত সহজে বিদারণীয় পদার্থ যা বিস্ফোরণমূখী হয়ে দ্রূত নিউট্রন সমপ্রতিক্রিয়াধারার সৃষ্টি করে সে কৌশলকে পারমাণবিক বোমা বলে।
১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগেই ফরাসী বিজ্ঞানীরা পারমানবিক বোমা ও শক্তি উৎপাদনের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে হিটলার ঘোষনা করেছিলেন যে জার্মানীর হাতে এমন এক ভয়ংকর গোপন অস্ত্র আছে যার গতি রোধ বা ধ্বংশ করার কৌশল কারোর জানা নেই। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বিজ্ঞানী ছাদউইককে হিটলারের গোপন অস্ত্রের শক্তির উৎস অনুসন্ধান করার অনুরোধ করেন। ছাদউইক তার প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছিলেন যে ১ থেকে ৩০ টন ইউরিনিয়াম যোগার করতে পারলে এই ধরনের বোমা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু অটো ফ্রিস ও রুডলফ পিয়ারলস বিজ্ঞানীদ্বয় হিসাব করে দেখালেন যে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের পরিবর্তে যদি খাঁটি ইউরেনিয়াম ২৩৫ মৌল ব্যবহার করা হয় তাহলে ১ থেকে ৩০ টন ইউরেনিয়ামের দরকার নেই বরং কয়েক পাউন্ড ইউরেনিয়াম হলেই বিষ্ফোরণ ঘটানো সম্ভব।
ইউরিনিয়াম ২৩৫ মৌল পৃথকীকরণ করার জন্য সেন্ট্রিফউজ প্লান্টের জন্য ৩৮ মিলিয়ন ডলার, বায়বীয় ব্যাপন প্লান্টের জন্য সীমাহীন ডলার, তড়িৎ চুম্বকীয় পৃথকীকরণের জন্য ১২ মিলিয়ন ডলার, প্লুটোনিয়াম গাদা তৈরির জন্য ২৫ মিলিয়ন ডলার এবং ভারী পানি উৎপাদনের জন্য ৩ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুই মিত্র ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় মিত্র রাশিয়াকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে পারমাণবিক বোমা তেরির উদ্যোগ গ্রহন করল। অবশ্য এটা জানা কথা যে ব্রিটেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কউই বলশেভিক রাশিয়াকে খুব একটা সুনজরে দেখে না। অতএব তাদের এই আচরণ অবাঞ্ছনীয় হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না।
কান টানলে যেমন মাথা এসে পড়ে, পারমানবিক বোমা সংক্রান্ত কোন আলোচনায় তেমনি, ‘ভারী পানির’ প্রসঙ্গ এসে পড়বেই। কিন্তু এই ভারী পানি বস্তুটি যেমন আমাদের অপরিচিত ঠিক তেমনি অতি দূর্লভ । আমরা জানি যে পানি একটি যৌগিক পদার্থ যার একটি অণুতে আছে দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু আর একটি অক্সিজেন পরমাণু । এর আগে ইউরিয়াম মৌলের আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলাম যে ইউরিয়াম তিনটি আইসোটোপয় অবস্থায় বিদ্যমান ইউরিনিয়াম ২৩৪, ইউরিনিয়াম ২৩৫ ও ইউরিনিয়াম ২৩৮। হাইড্রোজেন মৌল দুইটি আইসোটোপিয় অবস্থায় প্রকৃতিতে বিরাজ করে প্রোটিয়াম, ডয়টেরিয়াম। প্রোটিয়ামের ভর সংখ্যা ১.০০৭৮২u। প্রকৃতিতে বিদ্যমান হাইড্রোজেনের শতকরা ৯৯.৯৮৫ ভাগ এই প্রোটিয়াম। কিন্তু শতকরা মাত্র ০.০১৫ ভাগ হাইড্রোজেন বিরাজ করে যে আইসোটোপীয় অবস্থায় তার নাম ডয়টরিয়াম এবং তার ভর সংখ্যা ২.০১৪০u। সুতরাং প্রোটিয়ামকে আমরা হাল্কা হাইড্রোজেন এবং ডয়টরিয়ামকে ভারী হাইড্রোজেন বলতে পারি।
আমাদের অতি পরিচিত পানির অণুতে আছে প্রোটিয়াম আর অক্সিজেন। কিন্তু আমরা যে ভারী পানির উল্লেখ করেছি সেই পদার্থটির অণুতে আছে ডয়টরিয়াম ও অক্সিজেন। এ জন্যই তাকে বলা হয় ভারী পানি। পারমাণবিক শক্তি বা অস্ত্র তৈরিতে একটি মহার্ঘ উপাদান এই ভারী পানি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় কয়েক বছর আগে থেকে পারমাণবিক শক্তি বা অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে চারটি সংস্থা গবেষণা চালাচ্ছিল। ব্রিটেনের থমসন কমিটি, ফ্রান্সের ফ্রেডারিক জোয়ালিয়োর নেতৃত্বে কলেজ ডি ফ্রান্স দল, জার্মান দল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিগস কমিটি। পারমাণবিক শক্তি ও বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে পরিচালিত গবেষণায় এই চারটি দলের মধ্যে ফরাসীরাই ছিল অগ্রগামী। ফরাসী দল ইতিমধ্যেই গ্রাফাইটকে মডারেটর হিসাবে ব্যবহার করে যে পরীক্ষা চালিয়েছিল তা থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব হয় নি। সুতরাং তারা ভারী পানিকে নিয়ন্ত্রক বা মডারেটর হিসাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। ১৯৪০ সালের প্রথম দিকে একমাত্র নরওয়ের রুকানে শিল্প মাত্রায় ভারী পানি তৈরী হচ্ছিল। ফরাসী বিজ্ঞানীরা ফরাসী সমরাস্ত্র মন্ত্রী দুত্রীকে এটা বোঝাতে সমর্থ হলেন যে নরওয়ের ভারী পানির ভান্ডার তাদের হস্তগত করা খুবই জরুরী। এ ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণের পুর্বেই ফরাসীরা যে সংবাদ পেল তা রীতিমত ভীতিকর।
গোয়েন্দা সুত্রে তারা জানতে পারল জার্মানরা যে শুধু নরওয়ে কারখানার গোটা মজুদ ভান্ডার কেনার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে তাই নয় তারা আরও বেশি পরিমাণে এবং নিয়মীত ভারী পানি সরবরাহের জন্য তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এ রকম জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় এগিয়ে এলেন লেফটেনান্ট জ্যাকুস আলিয়ার নামে একজন তরুন ফরাসী। আলিয়ার ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তাকে ফরাসী গোয়েন্দা সংস্থার একটি বিশেষ শাখায় একজন অফিসার হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। জার্মানদের পারমাণবিক গবেষণা সম্বন্ধে ফরাসীদের জ্ঞাত সব কিছুই আলিয়ার সমরাস্ত্র মন্ত্রীকে ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু এই জ্ঞান ছাড়াও তার যে গুণটি ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ তা হল তিনি যে ব্যাঙ্কের সদস্য ছিলেন সেই ব্যাঙ্কের বিরাট আর্থিক লগ্নি ছিল নোর্স্ক হাইড্রো কোম্পানীতে। আর এই হাইড্রো কোম্পানীই ছিল রুকান ভারী পানি কারখানার মালিক। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে আলিয়ার অসলোর উদ্দেশ্যে প্যারিস ত্যাগ করেন। পথে স্টকহল্ম থেকে তিনি তাদের গোয়েন্দা সংস্থার তিনজন সদস্যকে সাথে নিলেন। নোর্স্ক হাইড্রো কারখানাটির মহাপরিচালক ছিলেন ডক্টর এক্সেল উবার্ট।
অসলোতে পৌছেই তিনি সত্বর উবার্টের সাথে সাক্ষাত করলেন। আলিয়ারের আগেই জার্মানরা উবার্টের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু উবার্ট যখন জার্মানীদের কাছ থেকে জানতে চান যে কি উদ্দেশ্যে তাদের ভারী পানির প্রয়োজন তখন তাদের জবাব গুলি শুনে তার মন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল। জার্মানরা আগে থেকে চেষ্টা করেও যা করায়ত্ত করতে পারে নি আলিয়ার তার বুদ্ধি ও কুশলতায় তা করায়ত্ত করতে সমর্থ হলেন। অর্থাৎ অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তি অনুযায়ী নরওয়ের কাছে মজুদ ১৮৫ কিলোগ্রাম ভারী পানি ফরাসীদের হস্তগত হল। সে সময় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ তুমুল ভাবে চলছিল। ফরাসীরা নরওয়ে থেকে কিভাবে ভারী পানির পাত্র গুলো আনবেন সে চিন্তায় অস্থির কারণ জার্মান সৈন্যরা এই ভারী পানির পাত্র গুলোর দিকে কড়া দৃষ্টি রাখতেন। প্রথমে পরিকল্পনা করা হয় ভারী পানির ছাব্বিশটি পাত্র সাবমেরিন যোগে ফ্রান্সে আনা হবে। কিন্তু পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে আবার সরে আসলেন। অনেক কৌশলে জার্মানদের চোখে ধূলো দিয়ে আলিয়ার ও তার সহকর্মীরা ভারী পানি ভর্তি ছাব্বিশটি পাত্র বিমানে করে স্কটল্যান্ডের এডিনবারায় নিয়ে আসেন। সেখান থেকে এ পাত্রগুলোকে আবার লন্ডনে চালান করা হয়।
১৬ মার্চে আলিয়ার ও তার সহকর্মীরা প্যারিসে ফিরে এলেন। সংগে নিয়ে এলেন সে সময়কার পৃথিবীতে মজুদকৃত সমুদয় ভারী পানি। এই ভারী পানির পাত্র গুলোকে রাখা হল একটি কলেজের গুদামের মাটির নিচে। পাশাপাশি সেই গুদামের উপরে এমন একটি ছাদ নির্মান করা হল যা এক হাজার পাউন্ড বোমায়ও ক্ষতি করতে না পারে।
১৯৪০ সালের ১০ মে জার্মানী ফ্রান্স আক্রমন করে। জার্মানরা ফ্রান্সের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ক্ষিপ্রতার সাথে অগ্রসর হতে থাকে। ফরাসী সরকারের পতন আসন্ন। পরাজয় যখন খুবই সন্নিকটে সেই পরিস্থিতিতে ফরাসী সমরাস্ত্র মন্ত্রী দুত্রি নানা জামেলার মধ্যেও এই মহার্ঘ ভারী পানির কথা ভুলে যাননি। পরাজয়ের মুখোমুখি দাড়িয়েও তার মনে হল এ সেই পদার্থ যা একদিন অবস্থান্তরে ফরাসীদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তিনি জুলিয়ো কুরিকে নির্দেশ দিলেন যে এগুলি যেন শত্রুর করায়ত্ব না হয় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। জোলিয় কুরি হলবানকে নির্দেশ দিলেন সেগুলি প্রথমে মধ্য ফান্সের মন্ট দোরে নিয়ে যেতে এবং সেখান থেকে পরে ক্লেয়ারমন্ট ফেরান্ডে নিয়ে ব্যাংক ডি ফ্রান্সের সিন্দুকে সুরক্ষিত রাখতে। ভারী পানির পাত্র, কিছু রেডিয়াম এবং মুল্যবান দলিলপত্র মোটর গাড়িতে তুলে হলবান সপরিবারে যাত্রা শুরু করলেন।
পরের দিন তিনি রিয়ম শহরে গিয়ে পৌছলেন। সেখানে একটি ছোট্র বাসায় হলবান তার যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করে নিলেন। তার আসল দরকার ছিল প্রবাহমান জলধারার। সেখানে জোলিয় কুরিসহ তার দলের অনেক বিজ্ঞানী উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই তারা পারমানবিক বোমা তৈরির ছোটখাট গবেষনার কাজ চালাতে থাকেন। হঠাৎ একদিন আলিয়ার এসে জানালেন শত্রু খুব দ্রুতবেগে অগ্রসর হচ্ছে তাই ফরাসী সরকার নির্দেশ দিয়েছেন যে ভারী পানির পাত্র গুলোকে অন্য কোন দেশে সরিয়ে নিতে।